বাংলাদেশের মেয়ে। বিলাতে পাড়ি দিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। থিতু হয়েছেন স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশ সুইডেনে। আর ঘুরেছেন পৃথিবীর নানা দেশে। শতক পূর্ণ করেছেন এরই মধ্যে। সর্বশেষ পরিব্রাজন ছিল আফ্রিকায়। সে গল্পই বলছেন নাজমুন নাহার
১২৫ দেশের মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকার ১৫টি দেশ যথেষ্ট দুর্গম। শুরু করেছিলাম মৌরিতানিয়া দিয়ে। সেখান থেকে সেনেগাল; তারপর গাম্বিয়া, মালি, গিনি, নাইজার, নাইজেরিয়া, টোগো হয়ে বেনিন। সড়কপথে ঘুরেছি। এসব দেশের বাসগুলো বাংলাদেশের বাসের মতো ভালো বা উন্নত মানের নয়। এক বর্ডার থেকে আরেক বর্ডারে যেতে ৭-৮ ঘণ্টা লেগেছে। দুটি দেশে আমি শেয়ার করা ট্যাক্সিতে গিয়েছি। ৭-৮ জন যাত্রীর সঙ্গে। অনেক সময় মোটসাইকেলেও গিয়েছি। ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার ছিল সেসব জার্নি। বাইক ভাড়া করার আগে আমি যেখানে থাকতাম, সেখানকার ফ্যামিলি বা লোকজনের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে নিতাম বাইকচালক সম্পর্কে। বর্ডারে যাওয়ার আগের রাস্তাগুলো খুব ভয়ানক ছিল। সবই মাটির; চারপাশে ম্যানগ্রোভ বন। রাস্তাগুলো ভীষণ উঁচু-নিচু। গভীর গর্তও দেখেছি। এগুলো সব পাথর, গাছ আর পোকামাকড়ে ভরা। বাইক থেকে নেমে হাঁটুপানি পার হতে হয়েছে। এমনকি পোকার কামড়ে রক্ত ঝরেছে। এভাবে আমি ১৩টি কূপ পার করেছি। এসব রাস্তায় অপহরণের ঘটনা আকছারই ঘটে। ফলে এ নিয়ে আতঙ্ক কাজ করেছে। আর নিজেকে মাসুদ রানার মতো মনে হয়েছে। সিয়েরা লিওন থেকে লাইবেরিয়া আর লাইবেরিয়া থেকে আইভরি কোস্টে যাওয়ার পথে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। রাস্তাগুলোয় বাস বা ভালো কোনো যানবাহন ছিল না। বাইকে যাওয়ার পথে এমনও হয়েছে যে রাস্তার কোথাও গাছের বড় গুঁড়ি পড়ে আছে। তা কোনোরকমে আমরা সরিয়ে পার হয়েছি। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুদূর পরপর ছনের ঘর দেখতে পাওয়া যায়। বর্ডারের এক ঘণ্টা আগে থেকেই পুলিশ সিকিউরিটি থাকে। কোথাও কোনো পুলিশ আমার সঙ্গে ঝামেলা করেনি। আমি আমার মিশনের কাগজপত্র দেখাতাম আর পত্রিকায় আমাকে নিয়ে করা নিউজগুলো দেখালে তারা আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, ছবি তুলেছে। অনেক সময় আমার ব্যাগও চেক করেনি। আফ্রিকায় ইমিগ্রেশন সেন্টারে থাকা মানুষগুলো এত ভালো যে তারা আমাকে বলেছে, ‘আমি কি তোমার বন্ধু হতে পারি?’ তারা আমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর নিয়ে পরে যোগাযোগ করেছে।
আমার কষ্টগুলো অনেকখানি কমে যেত জঙ্গলে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে। বাইকে আমাকে সেই ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যেও বড় মোটা জ্যাকেট পরে চলতে হয়েছে। মুখে কাপড় বেঁধে রাখতাম আর চোখে সানগ্লাস। ধুলাবালি বা বাইক থেকে পড়ে গেলে রক্ষা পাওয়া যেত কিছুটা।
মৌরিতানিয়া শহরের চারপাশের পুরো রাস্তায় বালু। এমনকি খাবারের মধ্যেও। বালিশেও। কারণ, এলাকার পুরোটাই মরুভূমি। সেখানকার ঘরবাড়িগুলোর খুব নাজুক অবস্থা। মানুষজন নাকে-মুখে কাপড় বেঁধে রাখে ধুলাবালির জন্য। দুদিন পরে আমি যাই মরু উপত্যকায় কয়েকজনের সঙ্গে। আমরা একটা থাকার জায়গা ঠিক করি। তাঁবু বাঁধি। ইচ্ছে ছিল সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত আর চাঁদের আলো দেখবো। কিন্তু হুট করে মরুঝড় শুরু হয়। এর মধ্যেই আমি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে পতাকা মেলে ধরেছি। ফলে, আমার চোখেমুখে খানিকটা বালি ঢুকে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমার মুখ, ঠোঁট, গলা ফুলে যায়। কারণ, বালিকণাগুলো খুবই ধারালো। লোমকূপে ঢুকে ক্ষত সৃষ্টি করে, ফলে রক্ত ঝরে। রাতে আমার জ্বর আসে। সেই অবস্থাতেই চাঁদের আলো, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখি। প্রতিটা মুহূর্ত এত সুন্দর ছিল, শারীরিক কষ্ট কিছুটা ভুলে যাই। পরের দিন চলে আসার পথে হুট করে মরুভূমির মধ্যে একটি হ্রদ খুঁজে পাই। কিন্তু সেখানে যেতে আমাকে সবাই মানা করে। কারণ, মরু এলাকা বলে চোরাবালির ভয় থাকে।
গিনি বিসাও থেকে গিনি কোনাক্রি যাওয়ার পথে ২৬ ঘণ্টা আটকে ছিলাম পথে। ড্রাইভার ছিলেন বৃদ্ধ আর জিপটিও ছিল অনেক পুরোনো। মাঝেমধ্যেই ড্রাইভারকে চাকা ঠিক করতে হয়। নামার জন্য দরজা খুলতে ও লাগাতে গেলেও আরেক ঝক্কি। স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে লাগাতে হয়। গিনির বর্ডার একটা নদী দিয়ে বিভক্ত ছিল। সেই নদী ম্যানুয়াল ফেরি দিয়ে পার হয়েছি। লোহার একটা চেইন ছিল দুপাশে লাগানো আর কাঠের ভেলার উপরে আমরা সবাই উঠে হাত দিয়ে টেনে টেনে পার হয়েছি। ইউনাইটেড আফ্রিকানরা একটা ইয়েলো কার্ড দিয়ে আফ্রিকার সব দেশে ভ্রমণ করতে পারে। তখন আমার মনে হয়েছে, আহা! এশিয়ায় যদি এমন ব্যবস্থা থাকতো।
সেই জিপ রাত তিনটার দিকে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের মধ্যে হুট করে বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভার আমাদের সবাইকে তার সঙ্গে জিপ ধাক্কা দিতে বলেন। কিন্তু লাভ হয় না। বিদেশি বলে আমাকে নিয়ে সবাই সন্ত্রস্ত ছিল। ভেবেছে আমার ওপর হামলা হতে পারে। কারণ, জায়গাটা ভালো নয়। আমরা রাতে চাঁদের আলোয় বনের মধ্য দিয়ে হেঁটেছি। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে দূরে একটা ছনের ঘর দেখতে পাই। ততক্ষণে আমি খুব ক্ষুধার্ত। সূর্যের আলো ফুটতেই দেখি আদিবাসী এক মহিলা। আমাকে দেখে হাসেন। আমার অবস্থা দেখে ইশারায় আমাকে তার ঘরের ভেতরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বলেন। দুটি বাঁশের সঙ্গে একটি দোলনার মতো ঝোলানো জায়গা, সেখানেই তারা ঘুমায়। কিন্তু শোবার চেষ্টা করেও পারি না। আমি একটু লম্বা হওয়ায় পা ঠেকছিল না। এরপরে একটা কাঠের উপরে পা লম্বা করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। মহিলা আমাকে বাদাম খেতে দেন। পানি ছিল না। পাশে দেখি মাল্টার গাছ। আমি গাছ থেকে পেড়ে একটা মাল্টা খেয়ে নিই। কারণ, পানি পাওয়া যাবে ৭-৮ কিলোমিটার দূরে। গ্রামবাসী সেখান থেকে পানি নিয়ে আসে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেখানে যাই পানি পান করতে। এরপরে আদিবাসীদের গ্রাম ঘুরে দেখি। একটা আলুসেদ্ধ খাই। এর আগে আমি একজন গ্রাম্য পুলিশকে জানিয়ে রাখি, আমাদের একটি গাড়ি নষ্ট হয়েছে আর কোনো গ্রামবাসী আমাদের যেন আক্রমণ না করে। পরে যখন গাড়ি ঠিক হলো, ক্ষুধার্ত হলেও আমরা খুশিতে চিৎকার করে উঠি।
দেরি হওয়ায় আমার হোটেল বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। তখন পাশে বসা যুবক মোহাম্মদকে বিষয়টা জানাই। সে আমাকে তার বাড়ি নিয়ে যায় গিনি কোনাক্রিতে। মোহাম্মদের মা আমাকে আলুসেদ্ধ খেতে দেন। তাদের বাসা টিন দিয়ে ছাওয়া। তাপমাত্রা তখন ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শরীর খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মাটিতে একটা পাতলা কাপড় বিছিয়ে নিই। বালিশ ছিল না। আমার ব্যাকপ্যাকটি মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এনার্জি অনেক কমে গিয়েছিল। টয়লেট ছিল বেশ দূরে। মনে হয়েছিল, আমার হিট স্ট্রোক হবে। তখন মোহাম্মদের মাকে বলি আমাকে চিনি আর পানি মিশিয়ে দিতে। সেটি খেয়ে একটু সুস্থতা বোধ করি। পরের দিন শহরে যাই। সেখানে গিয়ে ভালো করে খাই।
গিনি কোনাক্রি থেকে যাই সিয়েরা লিওন। শহর থেকে বর্ডারে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাইকে যাচ্ছিলাম। বাইকচালক একটু বেশিই কথা বলছিল। ভেতরে ভূতের ভয় পাচ্ছিলাম। ইমিগ্রেশন অফিসের পুলিশকে দেখে স্বস্তি আসে। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমাকে তিনি আর বর্ডার পার হতে দেননি। অথচ তখন আমার পক্ষে আবার শহরে ফেরত যাওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি তাদের গেস্টহাউজে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেটাও আবার জঙ্গলের মধ্যে। তা ছাড়া ভালো খাবারও ছিল না। পরদিন সকালে তিনি আমাকে নিতে আসেন। চা-নাশতা করিয়ে ভিসা দিয়ে আর একজন বাইকার ঠিক করে দেন। যাতে আমাকে সিয়েরা লিওনের ফ্রি টাউনে ঠিকমতো নামিয়ে দেয়।
সেনেগালের ইমিগ্রেশনে থাকাকালীন এক অফিসার ভদ্রমহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে তার ছোট বোনের নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। আমি জানিয়েছিলাম যে কবে আসবো। কিন্তু আমি সেদিন যেতে পারিনি বর্ডার বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। তারা সারা রাত আমার জন্য জেগে ছিলেন। আমার ফোনে নেটওয়ার্ক ছিল না বলে যোগাযোগও করতে পারিনি। শহরে পৌঁছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা গাড়ি করে আমাকে নিতে আসেন। সেই অফিসারের ছোট বোন ডোরা আমাকে নানান জায়গায় নিয়ে যান। ওই সময়ে তাকে কেউ ফোন করলে সে বলেছে, ‘আমাকে ফোন করবে না। আমি ব্যস্ত আছি। আমার জেসি এসেছে।’ আমি তখন জেসির মানে জানতে চাই। জেসি মানে জাস্ট কাম। ওরা ট্যুরিস্টদের জেসি নামে ডাকে। আমি সেখান থেকে লাইবেরিয়া যাওয়ার জন্য ভিসা করি। ডোরা আমাকে জানান, তিনি কখনো সিয়েরা লিওনের বাইরে যাননি। আমার সঙ্গে যেতে চান। তিনি আমার সঙ্গী হয়ে যান।