না, দূর থেকে তাজমহলের শ্বেত শুভ্র রূপ দেখে বোঝার উপায় নেই – এর গায়ে এতো সুক্ষ কারুকাজের সৌন্দর্য আঁকা আছে। শ্বেত পাথরের গায়ে যেমন লাল চুনি, সবুজ পান্না, হলুদ অ্যাম্বার দিয়ে লতা পাতা আঁকা আছে, ঠিক তেমনি করে কালো জেড পাথর দিয়ে আঁকা চমৎকার নক্সা – ক্যালিগ্রাফি, নজর কেড়ে নেয়।
তাজের শ্বেত পাথরের গায়ে এই নিখুঁত ক্যালিগ্রাফি দেখে অবাক হতেই হয়। আর সেটাই মনে হয়, তাজের আসল রূপ, আসল সৌন্দর্য, যা কাছে গেলে আরও ভালো ভাবে বোঝা যায়। তাজের প্রধান গম্বুজে ঢোকার মুখে সেই অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়।
সতেরো শতাব্দীর ঐ ক্যালিগ্রাফি গুলোর সুক্ষ নক্সা দেখে বোঝাই যায়, সাদা পাথর খোদাই করে করে কালো পাথরের নক্সা ফুটিয়ে তুলতে কি পরিমাণ সময়, ধৈর্য, পরিশ্রম, পটুত্ব ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হয়েছিল। এ এক অপূর্ব শিল্প – যেখানে সাধারণ এক অক্ষর শিল্পের আকার ধারণ করে এক ছবি ফুটিয়ে তোলে।
তাজমহলের প্রধান চত্বরে নানান জায়গায় এই ক্যালিগ্রাফি নক্সা দেখা যায়। আর এই ক্যালিগ্রাফি গুলো আসলে কোরান থেকে তুলে নেওয়া নানান বানীর সমন্বয়। আর কোরানের বানী দিয়েই কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
আর তাজের গায়ে ঐ সুক্ষ কারুকাজের জন্যে যার নাম উঠে আসে তিনি হলেন আব্দুল হক, তিনি ইরান থেকে শাহজাহানের দরবারে এসেছিলেন, এবং তিনি এক দক্ষ ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। সেই সময়ে Thuluth script দিয়ে কোরানের বানী আঁকার রেওয়াজ ছিল।
শোণা যায়, কোরান থেকে বিশেষ ঐ বানী গুলো আব্দুল হক নিজে তাজের চত্বরকে সাজানোর জন্যে বেছে নিয়েছিলেন। শাহজাহান তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘আমানত খান’। শুনেছি, তাজের ক্যালিগ্রাফির কয়েকটা প্যানেলে আমানত খানের সাক্ষরও দেখা যায়।
দেখেছি তো, পৃথিবীর নানা জায়গার স্থাপত্য, কোথাও তো এতো সূক্ষ্মতা দেখিনি, দেখিনি এতো মনোযোগ। একটা বিশাল স্থাপত্যকে মানুষ নিজের হাতে এতোটা সাজিয়ে দিতে পারে – তা হয়তো নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না।
সেইদিন তাজের একদম কাছে গিয়ে সেই ক্যালিগ্রাফি গুলো দেখে অন্তরে বুঝেছিলাম, তাজমহল শুধু এক প্রাচীন স্থাপত্য নয়, ইতিহাস নয়, চলে যাওয়া সময়ের শুধু এক ছাপ নয় – এ সময়ের যাত্রায় মানুষের দীর্ঘ দিনের ধৈর্য, পরিশ্রম, যত্ন, শিল্প চেতনা, ভালোবাসা, সমন্বয়, মেলবন্ধন ও স্থায়িত্বের প্রতীক।